জন্ম থেকে শুরু করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে একটা বয়সে গিয়ে কার্যক্ষমতায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। এরপর বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন অংশের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে গিয়ে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনই একটি প্রক্রিয়ার নাম অস্টিওপরোসিস বা হাড়ের দুর্বলতা। এর কারণে আমাদের শরীরের হাড়গুলো নরম হয়ে যায় এবং সামান্য আঘাতেই ভেঙে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্খানগুলো হচ্ছে মেরুদণ্ডের হাড়, হাতের কব্জি ও কোমরের হাড়গুলো। এক হিসাবে দেখা গেছে, আমেরিকায় অস্টিওপরোসিস-জনিত হাড়ভাঙা রোগীর সংখ্যা বছরে ১৩ লাখ এবং এর জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো তথ্য-উপাত্ত জানা না গেলেও ক্ষতির পরিমাণ অবশ্যই কম নয়।
বার্ধক্যের কারণে হাড়ের দুর্বলতা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও অন্যান্য কারণ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। অস্টিওপরোসিসের কারণে হাড়গুলো দুর্বল হয়ে পড়লে শরীরের ওজন বহনকারী বিভিন্ন অংশ যেমন কোমর, হাঁটু, গোড়ালি প্রভৃতি স্খানে ব্যথা হতে পারে। মেরুদণ্ডের দুর্বলতার কারণে কুঁজো হয়ে যাওয়া বা অন্যান্য দৈহিক বিকৃতি ঘটতে পারে। সর্বোপরি সামান্য আঘাতেই যেকোনো স্খানের হাড় ভেঙে গিয়ে আনুষঙ্গিক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। ঋতুস্রাব বìধ হয়ে যাওয়ার বা মেনোপজের পরবর্তী বয়সের মহিলারা অস্টিওপরোসিস-জনিত হাড় ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারে সর্বাধিক ঝুঁকির সম্মুখীন।
অস্টিওপরোসিসের কারণ
(১) বয়স আমাদের শরীরের হাড়গুলো ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে সর্বোচ্চ ঘনত্বে পৌঁছে। এ ক্ষেত্রে তা কার বেলায় কতখানি শক্তিশালী হবে তা নির্ভর করে জাতিগত, বংশগত বৈশিষ্ট্য; পর্যাপ্ত পুষ্টি ও দৈনন্দিন দৈহিক কার্যকলাপের ওপর। এরপর ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের পর থেকে এই হাড়গুলো বয়সের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে পড়ে।
(২) এস্ট্রোজেনের অভাব মহিলাদের বেলায় ঋতুস্রাব বìধ হয়ে যাওয়ার পর এস্ট্রোজেন নামক হরমোনের অভাবে উপরে উল্লিখিত বার্ধক্যজনিত হাড়ের ক্ষয় খুব দ্রুত হতে থাকে এবং এর হার পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি।
(৩) বংশগত ধারা বংশগত কারণে অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি কোনো মহিলার অস্টিওপরোসিসের কারণে হাড় ভেঙে যায় তবে তার মেয়ের ভবিষ্যতে একই জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণ।
(৪) জীবনযাত্রার ধরন নিয়মিত দৈহিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করলে অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। ধূমপান, অতিরিক্ত চা ও মদপান এ রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। পুষ্টি খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে শরীরের হাড় দুর্বল হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বয়:সìিধকালে ক্যালসিয়ামের দৈনিক চাহিদা ১২০০ থেকে ১৫০০ মি. গ্রাম, পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে ১০০০ মি. গ্রাম এবং ৬৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে চাহিদা দৈনিক ১৫০ মি.গ্রাম।
(৬) অন্যান্য যারা অন্য কোনো রোগের জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে গ্রহণ করছেন তাদের অস্টিওপরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আবার যাদের থাইরয়েড গ্লান্ডের রোগের জন্য শরীরে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় তারাও অতিরিক্ত ঝুঁকির সম্মুখীন হন। যেকোনো কারণে বহুদিন শয্যাশায়ী হয়ে থাকলে হাড় থেকে ক্যালসিয়াম বের হয়ে যায় ও তা অস্টিওপরোসিসের কারণ হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
নিয়মিত দৈহিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে হবে।
সুষম ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য, এক গ্লাস দুধে প্রায় ২৫০ মি.গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে।
অনেক ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ও মাল্টি ভিটামিন ট্যাবলেট গ্রহণ করা যেতে পারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে অ্যালেনড্রনেট অথবা ক্যালসিটোনিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এ জাতীয় ওষুধ হাড়ের ক্ষয় রোধ করে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়।
মহিলাদের বেলায় ঋতুস্রাব বìেধর পরে অ্যাস্ট্রোজেন জাতীয় ওষুধ গ্রহণ অস্টিওপরোসিস রোধে সবচেয়ে বেশি কার্যকর। এ ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা হলো অ্যাস্ট্রোজেন থেরাপি মেনোপজ সংক্রান্ত অন্যান্য অসুবিধাও দূর করে। তবে এর বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধাগুলো চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
আমাদের জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবীণ নাগরিক এবং এদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আমাদের উচিত এদের সমস্যার দিকে নজর দেয়া যাতে তারা সমাজের বোঝা না হয়ে দাঁড়ান এবং তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা তরুণ সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন