সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১০

ডায়াবেটিসঃ কি খাবেন, কি খাবেন না

ঘন ঘন প্রস্রাব। বেশি পিপাসা। খুব ক্লান্তি। বেশি বেশি খিদে পাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ শরীরে দেখা দিলেই ডায়াবেটিসের কথা মনে হয়ে যায়। কারণ এভাবেই ডায়াবেটিসের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ডায়াবেটিস একটি প্রাচীন রোগ। Diabetes গ্রিক শব্দ। Diabainein থেকে উৎপন্ন। এ রোগে প্রচুর পরিমাণ প্রস্রাব বের হয়ে যায় বলেই এর নাম Diabetes

সাধারণভাবে ডায়াবেটিস বলতে Diabetes Mellitus -কেই বোঝানো হয়। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের প্রস্রাবের স্বাদ মিষ্টি বলেই এই নামকরণ। ডায়াবেটিস মেলিটাস ছাড়াও আছে ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস, যাতে প্রস্রাবের কোনো স্বাদ থাকে না।

ডায়াবেটিস এক ধরনের বিপাকঘটিত রোগ। আমাদের শরীরের পাকস্থলীর ঠিক পেছনে অগ্নাশয় নামে একটি গ্রন্থি আছে, সে গ্রন্থির আইলেটস অব লাঙ্গেরহান্সের বিটাকোষ ইনসুলিন তৈরি করে। তারপর সে ইনসুলিন রক্তে নিঃসৃত হয়। মূলত রক্তে শর্করার পরিমাণ যখন বেড়ে যায় (যেমন আহারের পর) তখন ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। আবার রক্তে শর্করার পরিমাণ যখন কমে যায় তখন ইনসুলিন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায় অথবা মন্থর হয়ে যায়। সুতরাং রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক রাখতে ইনসুলিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইনসুলিনের জন্যই রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি বাড়তে পারে না। যদি কোনো কারণে অগ্নাশয় পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে কিংবা অগ্নাশয়ের তৈরি ইনসুলিন যদি শরীরে ঠিকমতো কাজে লাগাতে না পারে তাহলে জীর্ণ খাদ্যের শর্করা শরীরের কোষে প্রবেশ করতে না পেরে রক্তেই থেকে যায়। এভাবেই শর্করার মাত্রা বাড়তে বাড়তে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়।

ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের­ ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস (টাইপ ওয়ান), ইনসুলিননির্ভর নয় এমন ডায়াবেটিস (টাইপ টু)।

ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিসের বংশগতভাবে চলার প্রবণতা। ইনসুলিননির্ভর নয় ডায়াবেটিস আরো বেশি জেনেটিকনির্ভর।

ডায়াবেটিসের চিকিৎসার অভাব নেই। আবার বলা যায়, ডায়াবেটিসের কোনো চিকিৎসা নেই। কোনো ওষুধেই ডায়াবেটিস নিরাময় করা যায় না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ অভিমত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, ইউনানী, আয়ুর্বেদ, হারবাল থেকে শুরু করে রয়েছে নানা পদ্ধতির চিকিৎসা। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরা যিনি যখন যা বলেন তারা তখন তাই করেন। এক কথায়, লোকের কথায় তারা নিজেরাই চিকিৎসা করেন। অনেকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার খুব একটা দরকারও মনে করেন না। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ চিকিৎসার অভাবে নানা ধরনের জটিলতায় ভুগতে থাকেন। যখন তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন তখন তার অবস্থা মোটেই ভালো থাকে না।

ডায়াবেটিস রোগীর রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যেসব বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া দরকার তা হচ্ছে (ক) শরীরের সঠিক ওজন, (খ) সঠিক খাদ্য (গ) ওষুধ (ঘ) ব্যায়াম (ঙ) শৃঙ্খলা (চ) শিক্ষা।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মোটা লোকদের, বিশেষত যাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত ওজন রয়েছে, তা অবশ্যই কমাতে হবে। ওজন কমালে ইনসুলিনের প্রতি শরীরের প্রতিরোধ কমে। ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হয়। হার্টের অসুখ আর স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কমে। ব্লাড পেশার কমে। রক্তের ফ্যাট অর্থাৎ কলেস্টরল আর ট্রাইগ্লিসেরাইডের পরিমাণ কমে।


ওজন কমাতে চাইলে ক্যালরি কমাতে হবে অথবা বেশি পরিশ্রম করে বাড়তি ক্যালরি খরচ করে ফেলতে হবে। এজন্য প্রথমে খাবার ফ্যাটের পরিমাণ কমাতে হবে, মানে, তেল, ঘি, মাখনের পরিমাণ খাবারে কমাতে হবে। অনেকে মনে করেন, ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদি শ্বেতসার জাতীয় কার্বোহাইড্রেট খাদ্য কমালেই ওজন কমে যাবে। কিন্তু এ ধারণাটা ঠিক নয়।

শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যে ফ্যাটজাতীয় খাদ্যের মতো বেশি ক্যালরি থাকে না। ফলে শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য ডায়াবেটিসের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। তাই খাবারে ফল, শাকসবজি, ভাত, রুটি, আলু খাওয়া কমানোর প্রয়োজন নেই। বরং ডায়াবেটিসে শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য আরো বেশি দরকার।
39;; mso-bidi-language: BN" lang="BN">ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যারা ট্যাবলেট খান কিংবা ইনসুলিন নেন, তাদের রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ ঠিক রাখতে শ্বেতসার জাতীয় খাবার বেশি দরকার। অর্থাৎ শ্বেতসার জাতীয় খাবার ডায়াবেটিস রোগীর হাইপো ঠেকাতে পারে। ডায়াবেটিসে প্রয়োজন সুষম খাদ্য। খাদ্য খেতে হবে প্রয়োজনমতো। যখন যা খুশি তা খাওয়া যাবে না। সময়মতো, পরিমাণমতো এবং সুষম খাবারই ডায়াবেটিস রোগীর পথ্য।

তবে খাবারে ফ্যাটের পরিমাণ অবশ্যই কমাতে হবে। ঘি, মাখন, মার্জারিন, চিজ, চর্বিযুক্ত গোশত ইত্যাদি কম খেতে হবে। ভাজা খাবারও কমাতে হবে। কারণ এসব খাবারে ক্যালরি বেশি থাকে। ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যায়। বেশি আঁশ আছে এমন শ্বেতসার জাতীয় কার্বোহাইড্রেট খাবার বেশি খেতে হবে। খাবারে আঁশ শরীরের কার্বোহাইড্রেট শোষণের হার কমিয়ে দেয়। শরীরে তাড়াতাড়ি কার্বোহাইড্রেট শোষিত না পারায় রক্ত শর্করার পরিমাণ তেমন বাড়তে পারে না।

বাজারে সাদা চিনিতে শুধু ক্যালরি ছাড়া আর কোনো পুষ্টি নেই। তাই চিনি খাবেন কম। লবণও খেতে হবে কম। খাবারের সাথে আলাদা লবণ নেয়া একেবারেই ঠিক নয়। তা ছাড়া রান্নায়ও লবণ কমানোর চেষ্টা করতে হবে। এখন আবার বাজারে ডায়াবেটিসের স্পেশাল খাবার, যেমন ডায়াবেটিস বিস্কুট, মিষ্টি ইত্যাদি পাওয়া যায়। এসব খাবারের দাম বেশি। উপকার বেশি নয়। স্পেশাল খাবারে কোনো স্পেশাল উপকার নেই। তা ছাড়া ডায়াবেটিসের জন্য আলাদা কোনো খাবারও নেই। ডায়াবেটিক ফুড বলেও কিছু নেই। ডায়াবেটিসের জন্য দরকার স্বাস্থ্যকর খাবার যাতে থাকবে ফ্যাট কম, লবণ কম, চিনি কম, আর আঁশ বেশি।

অতএব, ফল, শাকসবজি, ভাত, রুটি, আলু খাওয়া কমানোর প্রয়োজন নেই। শ্বেতসার জাতীয় কার্বোহাইড্রেট খাবার অবশ্যই খেতে হবে। তবে তা সময়মতো খাবেন। যখন খুশি তখন খাবেন না। সবসময় পরিমাণ মতো খাবেন। ফ্যাটের পরিমাণ কমাবেন। ঘি, মাখন, মার্জারিন, চিজ, চর্বিযুক্ত গোশত ইত্যাদি কম খাবেন। ভাজা-পোড়াও কম খাবেন। যেসব খাবারে ক্যালরি বেশি থাকে তা পরিহার করবেন যেমন চিনি। চিনির বদলে স্যাকারিন জাতীয় কৃত্রিম শর্করা খাওয়া যেতে পারে। আর মনে রাখতে হবে, শরীরের ওজন ঠিক রাখতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সবসময় সুচিন্তা করতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। তাহলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে।

চিকিৎসার সুযোগ

প্রচলিত ধারায় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় ডায়াবেটিক রোগীদের বেশ উন্নত ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। এর পাশাপাশি অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতেও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা রয়েছে। বিশেষভাবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ডায়াবেটিস রোগীর জটিলতা নিরসনে সুব্যবস্থা রয়েছে। বিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এ ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম। ইউনানী, আয়ুর্বেদি ও হারবাল পদ্ধতিতেও রোগীরা উপকার পাচ্ছেন। তাই সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। নতুন চিকিৎসা ধারণায় সমন্বিত চিকিৎসা নতুন আশার আলো দেখাতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন