শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১

নাক ডাকা নিদ্রাকালীন স্বাস্থ্য সমস্যা


নাকডাকা একটি অতি পরিচিত নিদ্রাকালীন সমস্যা, যা যে কোন বয়সের মানুষের হতে পারে। তবে এটি সাধারণত পুরুষের হয়। যারা স্থূলকায় তাদের এ সমস্যা বেশি হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শতকরা ৪৫ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই মাঝেমধ্যে নাক ডাকেন এবং ২৫ ভাগ মানুষ সব সময় নাক ডাকেন। মাঝেমধ্যে নাকডাকা স্বাস্থ্যের জন্য তেমন ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু তা অনেক সময়ই বিছানাসঙ্গীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। যারা নিয়মিত নাক ডাকেন তারা নিজেরা যেমন বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হন তেমনি তার বিছানাসঙ্গীও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নন।
নাকডাকা কী
এটি শ্বাসনালির উপরিভাগের কম্পনজনিত শব্দ, যা ঘুমের সময় শ্বাসনালির আংশিক বাঁধার কারণে নিঃশ্বাস আদান-প্রদানের সময় উৎপন্ন হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর প্রভাবে    Obstructive sleep apnea syndrome  নামক রোগ সৃষ্টি হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই শব্দ মৃদু আবার কিছু ক্ষেত্রে উচ্চঃস্বর বিরক্তিকরভাবে তৈরি হয়।
কারণ
মূলত আলজিহ্বা এবং মুখগহ্বরের তালুতে গঠনগত সমস্যার জন্য মানুষ নাকডাকে এবং Obstructive sleep apnea syndrome  -এ আক্রান্ত হয়। তথাপি নিুলিখিত কারণগুলো এর জন্য প্রধানত দায়ীÑ
* স্থূলকায় ব্যক্তিরা যাদের গলগহ্বর এবং শ্বাসনালির উপরিভাগে চর্বি জমে নালীপথ সরু হয়ে গেলে। 
* অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান করলে। 
* ঘুমের সময় গলগহ্বর এর পেশির দুর্বলতা বা টোন কমে গেলে শ্বাসনালি সরু হয়ে যায়। 
* চিত হয়ে ঘুমালে জিহ্বার পেশি শৈতল্য হয়ে জিহ্বা পিছন দিকে সরে গিয়ে শ্বাস প্রবাহে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে। 
* নিচের চোয়ালের অবস্থানগত ত্র“টির কারণে । 
* দুই পাশের টনসিল বড় হয়ে গেলে। 
* আংশিক নাশিকা গহ্বর বন্ধ থাকলে, যেমন- নাকের পলিপ , নাকের তরুণাস্থি বাঁকা , সাইনাসের প্রদাহ এবং অ্যালার্জিজনিত সর্দি । 
* যাদের গলগহ্বর-এর তালু এবং আলজিহ্বা বড় থাকে, যেমন- Acromegaly  রোগের কারণে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। 
* পেশি শীতলীকরণ ঔষধ (ঘুমের ঔষধ) সেবন করলে। 
স্বাস্থ্যগত প্রভাব 
* নিয়মিত নাকডাকা ব্যক্তিগণ নানাবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যার ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। শ্বাসনালী আংশিক বন্ধ থাকার কারণে   Obstructive sleep apnea syndrome  হতে পারে। যার প্রভাবে ঘুমের মধ্যে ১০ সেকেন্ড-এর সমান বা বেশি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে থাকে। প্রবলভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতিরাতে শতাধিকবার পর্যন্ত শ্বাসরুদ্ধতার পর্ব হতে পারে। 
* ঘুম ঘন ঘন ভেঙে যায়, যদিও তিনি তা উপলব্ধি করতে পারেন না। 
* নিজ এবং বিছানাসঙ্গী নির্মল ঘুম থেকে বঞ্চিত হন, যা তাকে দিনের বেলায় তন্দ্রাচ্ছন্ন রাখে, সকাল বেলায় মাথা ব্যথা করে, দৈনিক কর্মকাণ্ডে বিরক্তি ভাব প্রকাশ পায় এবং কাজ কর্মে মনোযোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
* মানসিক এবং সামাজিক অশান্তি তৈরি হয়। 
* যৌনকর্মের উৎসাহ কমে যায়। 
* রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। 
* বারবার নিদ্রাভঙ্গের কারণে রক্তে ঈধঃধপযড়ষধসরহব যড়ৎসড়হব এর নিঃসরণ বেড়ে যায়, ফলে উচ্চ রক্তচাপ (ঐুঢ়বৎঃবহংরড়হ) এবং ডায়াবেটিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হন। 
* বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে,  Obstructive sleep apnea syndrome  উপসর্গের কারণে হƒদরোগ ৩৪% এবং মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত ৬৭% ঝুঁকি বাড়ে। 
* উচ্চস্বরে নাক ডাকলে এর কম্পন গলার প্রধান দুটি রক্তনালির  (Carotid artery)   atherosclerosis   পরিবর্তনের মাধ্যমে রক্ত পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করে। 
* তন্দ্রাজনিত কারণে চালকদের গাড়ির দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। 
* শিশু বা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনায় অমনোযোগিতা বা Atention deficit disorder   হতে পারে। 


রোগ নির্ণয় প্রণালী 
* আক্রান্ত ব্যক্তির নিদ্রা ব্যাঘাতজনিত বিভিন্ন সমস্যার ইতিহাস 
* ধূমপান ও মদ্যপানের ইতিহাস 
* ঘুমের ঔষধ সেবনের ইতিহাস 
* বিছানা সঙ্গীর সাক্ষ্য 
* আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স  


নিুলিখিত পরীক্ষাসমূহ
* ব্যক্তির ওজন 
* BMI (Body mass index)
* গলার পরিধি পরিমাপন (পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৭ ইঞ্চির বেশি হলে গলা এবং গলগহ্বর অতিরিক্ত চর্বি আছে বুঝায়)। 
* রক্তচাপ পরিমাপন 
* গলগহ্বর, আলজিহ্বা ও টনসিল পরীক্ষা করা। 
* নাসিকারন্ধ্র/নালীর পরীক্ষা 
* জিহবার আকৃতি বৃদ্ধি পরীক্ষা  (macroglossia)
গবেষণাগারে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা 
* Cephalometric X-ray  
* স্লিপ স্টাডি- পলিসমনোগ্রাফি
* সারারাত পালস অক্সিমিটার 
* লিপিড প্রোফাইল 
* ইসিজি 
* বুকের এক্সরে 


চিকিৎসা 


শ্বাসনালির সরুতা প্রতিরোধ করে নাকডাকা নিরাময় করা যায়, সরুতা প্রতিরোধে নিুলিখিত পদক্ষেপগুলো অবলম্বন করা যায়- 
* শরীরের ওজন কমানো 
* ধূমপান এবং মদ্যপান থেকে বিরত থাকা 
* ঘুমানোর পূর্বে নিদ্রাউত্তেজক , ট্রাংকুলাইজার , এন্টি হিস্টামিন জাতীয় ঔষধ সেবন থেকে বিরত থাকা। 
* রাতে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, ঘুমানোর ৪ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার গ্রহণ করা উচিত। 
* নিয়মিত একই সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস করা। 
* একটু উঁচু বালিশে, একপাশে কাত হয়ে ঘুমানো। 
* যে কোন অ্যালার্জি জাতীয় দ্রব্য বা খাদ্য বর্জন। 
উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরেও যদি নাক ডাকা এবং তদসংক্রান্ত সমস্যার উন্নতি না হয় তাহলে বক্ষব্যাধি এবং নাক, কান, গলার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। সেই ক্ষেত্রে কিছু যান্ত্রিক সহায়তা এবং শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব। 
কোন ধরনের ঔষধ এখন পর্যন্ত নাকডাকা চিকিৎসার জন্য কার্যকরী নয়, তবে নিুলিখিত ঔষধগুলোর কার্যকারিতা গবেষণায় পরিলক্ষিত হয়েছে। 
সিউডোইপিড্রিন ও ডমপেরিডন 
মেড্রোক্সিপ্রোজেস্টেরন এর সমন্বয় 
এসেটাজোলামাইড, প্রোট্রিপটাইলিন 
এল-ট্রিপটোফেন 
মোডাফিনিল 


বিকল্প চিকিৎসা
*  Didgeridoo বাজানো 
*      Singing  প্রতিদিন ২০ মিনিট এভাবে তিন মাস নিয়মিত গান গাওয়া, মজার বিষয় হল পেশাদার গায়ক/গায়িকারা খুব কমই নাক ডাকেন 
* আকুপাংচার 
*      বিছানাসঙ্গীর সহায়ক পদ্ধতি
*  Earplugs  ব্যবহার করা। 
নেট থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন