সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

দেশের আট ভাগ মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত

দেশে মোট জনসংখ্যার আট ভাগ মানুষ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত। সচেতনতার অভাবে এ নীরব ঘাতক ব্যাধিতে শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ লোক এইচআইভি/এইডসে মৃত্যুবরণ করে, তার চেয়েও অনেক বেশি লোক প্রতিদিন হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভার রোগে মৃত্যুবরণ করে। হেপাটাইটিস ‘বি’ এইচআইভি/এইডসের তুলনায় ১০০ ভাগ বেশি সংক্রামক। এ কারণে হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাসকে নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। হেপাটাইটিস যকৃৎ (লিভার) প্রদাহজনিত একটি রোগ। এ রোগে মা আক্রান্ত হলে শিশুর সংক্রমণের আশংকা থাকে। এছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন, জীবাণু সংক্রমিত সুচ বা রেজার ব্যবহারের মাধ্যমেও এই ভাইরাসটি ছড়ায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রুহুল হক এই তথ্য স্বীকার করে বলেন, এটা মারাত্নক রোগ হলেও সচেতন থাকলে এ রোগ থেকে পরিত্রাণ সম্ভব। বর্তমান সরকার এ রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে তিনি জানান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দেশে ৫-৬ বছর ধরে নবজাতককে সঠিক সময়ে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা দেয়া হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনায় বলা আছে, জšে§র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা দিতে হবে। পরে দিলে শিশুর দেহে ভাইরাস সংক্রমণের আশংকা থাকে। অথচ দেশে এই টিকা দেয়া হচ্ছে  জ্ন্মর ছয় সপ্তাহ পর। ২০০৫ সালে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা অন্তর্ভুক্তির পর থেকে এটাই প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান। চিকিৎসকরা বলছেন, শিশু এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার দীর্ঘমেয়াদি যকৃৎরোগ হওয়ার আশংকা থাকে। পরিণামে অকাল মৃত্যু ঘটে ওই শিশুর। ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস এলায়েন্সের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ১২ জনে ১ জন হেপাটাইটিস ‘বি’ অথবা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। বিশ্বে প্রতিবছর এই দুই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা প্রায় এক দশমিক পাঁচ মিলিয়ন। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের প্রতিষেধক ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র মানুষ টিকাদান কর্মসূচির আত্ততায় আসতে পারছে না। এর ভয়াবহতা কমাতে ভাইরাসটির টিকার ব্যয় আরও কমিয়ে তা সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
রাজধানীর একটি হাসপাতালে কথা হয় এই ভাইরাসে আক্রান্ত ৩৭ বছর বয়সী সাত্তার মিয়ার সঙ্গে । তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন দু’বছর ধরে। মাসে ওষুধের জন্য তার খরচ হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার টাকা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হেপাটাইটিস-বি ইমিউনাইজেশন : আইডেন্টিফাইং দি আইডিয়াল সিডিউল শীর্ষক এক উত্থাপিত পত্রে বলা হয়েছে, ছয় সপ্তাহ বয়সে টিকা দেয়ার কারণে ৬০ শতাংশ নবজাতক এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছে। সূত্র বলছে, জ্ন্মর  ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে টিকা দেয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে ৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিও গঠন করেছে সরকার। দেশের বেশির ভাগ শিশুর  বাড়িতে হয়। সে ক্ষেত্রে এ বিপুলসংখ্যক নবজাতককে কিভাবে সময়মতো টিকা দেয়া যায়, তা বিবেচনায় নিয়ে কমিটি কাজ করছে। সূত্র মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সঠিক সময়ে টিকা দেয়ার ব্যাপারে বারবার জোর দিয়েছে। নির্দেশনা ছাড়াও হেপাটাইটিস বিষয়ে গত বছর ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদের (এক্সিকিউটিভ বোর্ড) সভার প্রতিবেদনে  জ্ন্মর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে টিকা দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কমিটির সদস্য লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব মোহাম্মদ আলী বলেন, বিশ্বের একাধিক দেশে জ্ন্মর২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশুরা এ টিকা পাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে বছরের পর বছর ভুল সময়ে টিকা দেয়ায় মারাত্নক ক্ষতি হচ্ছে শিশুর স্বাস্থ্য। তিনি বলেন, সরকার হেপাটাইটিস-‘বি’ প্রতিরোধে ২০০৪ সালের জুলাই মাস থেকে ‘ইপিআই’ প্রোগ্রামে হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন যুক্ত করেছে। জ্ন্মর ৬ সপ্তাহ থেকে শিশুকে তিন ডোজ ডিপিটি টিকার সঙ্গে তিন ডোজ হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে (৬, ১০ ও ১৪তম সপ্তাহে)। দেশে গর্ভবতী নারীদের তিন দশমিক পাঁচ ভাগই এ রোগে আক্রান্ত। দেশের অনেক মানুষ ভাইরাসটি বহন করলেও তারা এ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। মানুষকে রোগটি সম্পর্কে জানাতে হবে। এই ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা ব্যয়বহুল হওয়ায় তাদের অনেকেই এ টিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হেপাটাইটিস ভাইরাসের টিকার ব্যয় আরও কমিয়ে তা সাধারণ মানুষের আয়ত্তে নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে যদি দেশেই হেপাটাইটিসের-বি টিকা উৎপাদন করা যায়, তবে সাধারণ মানুষ এর প্রকৃত সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, সব সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও ইপিআই কার্যক্রমবহির্ভূত শিশুদের টিকাদান, হেপাটাইটিস প্রতিরোধে প্রতিষেধক টিকাকে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা এবং দেশে একটি ভ্যাকসিন প্লান্ট স্থাপন, লিভার রোগের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ওষুধ দেশে তৈরির ব্যবস্থা করে সহজলভ্য ও রোগীদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। যা লিভার রোগের প্রতিরোধ, চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার কাজে সহায়ক হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন