STRESS বা উদ্বেগ আজকের দিনে এমন এক সমস্যা যা প্রত্যেক মানুষের জীবনে বর্তমান। স্ট্রেস নেই এমন মানুষ এখনকার দিনে হয়তো পাওয়া দুষ্কর। এর প্রভাব ধীরে ধীরে আমাদের মন আর মস্তিষ্কের ওপর পড়তে থাকে। এর ফলে শরীর এবং মন উভয় ক্ষেত্রে পজিটিভ ও নেগেটিভ প্রভাব পড়ে।
পজিটিভ প্রভাব আমাদের কিছু করে দেখাতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে আর নেগেটিভ প্রভাব আমাদের সব দিক থেকে ক্ষতি করে থাকে। তাই স্ট্রেস কম করা একান্ত প্রয়োজন।
কিন্তু কীভাবে আপনি আপনার স্ট্রেস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন তার কয়েকটি উপায় আপনাকে জানানো হলো—
পরিমাণমত খাবার-দাবার করুন
আমাদের ধারণা আছে অ্যালকোহল গ্রহণ করলে বা বেশি পরিমাণে খাওয়া-দাওয়া করলে স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু খুব বেশি পরিমাণে খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস স্ট্রেস কমানোর বদলে তা বাড়িয়ে তোলে। তাই স্ট্রেস বেশি হলে পরিমাণমত খাবার খান। খুব বেশি খাবার খাওয়ার প্রয়োজন নেই।
নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিন
আপনি মনে রাখুন, অপরের ইচ্ছা পূর্ণ করা বা অন্যের অপেক্ষা করাই আপনার একমাত্র কাজ নয়। আপনার মনের মতো বিষয় বা বক্তব্য না হলে সেই প্রসঙ্গে না বলার অধিকার আপনার আছে। অন্যদের ইচ্ছা পূরণ করা থেকে নিজের ইচ্ছা অনুসারে চলুন। নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিন। আপনারও নিজস্ব কিছু ইচ্ছা আছে এবং তা পূরণ করা বা সেই ইচ্ছা অনুসারে জীবন ধারণ করার অধিকার আপনার আছে। আপনি নিজের অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন।
খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করুন
স্ট্রেস-ফ্রি হতে গিয়ে খুব বেশি চা বা কফি পান বা সিগারেট খাওয়ার মতো বদ অভ্যেসে অভ্যস্ত হবেন না। এর মধ্যে যে নিকোটিন থাকে তা স্ট্রেস বাড়িয়ে তোলে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
খুব কঠিন নয় এমন কিছু ব্যায়াম দৈনিক চর্চা করুন। মেডিটেশন বা ধ্যান, যোগব্যায়াম বা অ্যারোবিক্সের চর্চার ফলে শরীর থেকে ‘এন্ডোফিন’ নির্গত হয় যা স্ট্রেস কম করে এবং পজিটিভ চিন্তা-ভাবনা জাগিয়ে তোলে।
নিয়মিত পড়াশোনা করুন
নিজেকে রিল্যাক্স রাখুন। রিল্যাক্সেশনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া জেনে নিন। নিয়মিত পড়াশোনা করুন। অবসর সময় নষ্ট না করে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান বাড়ানোর জন্য নিয়মিত পড়াশোনার চর্চা করুন।
স্ট্রেসের কারণ কম করার চেষ্টা করুন:
প্রত্যেক ব্যক্তি মনে করেন জীবনে চাহিদার কোনো শেষ নেই। আর সব চাহিদা পূরণ করার জন্য এই জীবনকাল যথেষ্ট নয়। টাইম ম্যানেজমেন্ট শেখায় কীভাবে কম সময়ের মধ্যে আপনার সব প্রয়োজনীয় কাজ আপনি শেষ করতে সক্ষম হবেন। আপনার মুখ্য কাজ কী, নিয়মানুবর্তিতার দ্বারা কীভাবে সব কাজ সম্পন্ন করা যায় তা মেনে কাজ করে দেখুন সব কাজ সম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আপনি আপনার পরিবার এবং নিজের জন্যও অতিরিক্ত সময় পেয়ে যাবেন।
আপনার গুরুত্ব উপলব্ধি করুন
আপনার কাজে আপনার চিন্তাধারা বা বিচার বুদ্ধির বাস্তব রূপ তুলে ধরে। আপনি কতটা ব্যস্ত তা কারও কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার নয়। তাই আপনার গুরুত্ব এবং ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করুন। নিজেকে সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলুন। আপনি নিজেকে গুরুত্ব দিলে তবেই অন্যরা আপনাকে গুরুত্ব দেবে। নিজের লক্ষ্য স্থির করুন, যদি সব কিছু ঠিক থাকে তবুও মনে রাখবেন, একশ’ শতাংশ সফলতা কেউ পায় না। লক্ষ্য ঠিক রেখে সঠিক চিন্তা-ভাবনা অনুসারে নিজের কাজ করে যান।
নিজের জন্য কাজ করুনআপনার যখনই মনে হবে আপনার ওপর খুব বেশি কাজের চাপ পড়ছে, তখন ভেবে দেখুন কী করলে আপনার ভালো লাগবে। যা করতে আপনার ভালো লাগছে তাই করুন।
কাজকে ভালোবাসুন, কাজই আপনাকে প্রতিদান দেবে- অগ্রাধিকার ঠিক করুন: যে কোনো নির্দিষ্ট দিনে আমাদের হয়তো একশটা কাজ হাতে থাকে। কিন্তু এর মাত্র ১০% থাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাকিগুলোর অধিকাংশ কাজই অনুরোধে ঢেঁকি গেলা বা জরুরি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবং এই শেষ কাজগুলোই আমাদের বেশিরভাগ সময় নিয়ে নেয়। ফলে দিন শেষে দেখা যায় অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলোই করা হয়নি।
এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করুন। কী কী করতে হবে এর তালিকা হয়ে গেলে গুরুত্বের ভিত্তিতে টিক চিহ্ন দিন। যেগুলো না করলেও চলে সেগুলো কেটে দিন। এতে প্রয়োজনীয় কাজগুলো বাদ পড়বেনা।
সময়কে ছোট ছোট কাজে ভাগ করে দিন কোন কাজ কখন করবেন তার জন্য সময় ভাগ করে নিন।অপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য দিনের অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল সময় বেছে নিন। যেমন. কাউকে ফোন করতে হলে দুপুরে খাওয়ার আগে করুন। এতে অহেতুক কথায় সময় নষ্ট হওয়ার সুযোগ কম থাকবে। আবার খুব মনোযোগ দিয়ে করতে হবে এমন কাজের জন্য সেই সময়টাই বেছে নিন যখন লোকজনের অহেতুক আসা-যাওয়া কম হবে এবং দীর্ঘক্ষণ কেউ বিরক্ত করবে না।
‘না’ বলতে শিখুন সব কাজের কাজী হতে যাবেন না। এমন অনেক কাজ আছে যেগুলো না করলেও চলে। আপনার দিন থেকে ঐ কাজগুলো বাদ দিতে চেষ্টা করুন। এতে যে কেবল সময় নষ্ট হয় তাই না, অহেতুক ঝামেলা আমাদের বেশি স্ট্রেসড্ করে তোলে। নিউ-ইয়র্কের এক রিসার্চ ফার্ম ‘বেসেক্স’ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় অপ্রয়োজনীয় মোবাইলে আমাদের প্রতিদিন ১ থেকে ২ ঘন্টা নষ্ট হয়, যা এক কর্মদিবসের ২৮%।
তাই বেছে কাজ হাতে নিন। যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু করছেন তখন ফোন সাইলেন্ট রাখুন। পরে কল-ব্যাক করুন- যখন গাড়িতে জ্যামে বসে আসেন অথবা এমন সময় যখন আপনার ব্যস্ততা কম। একইভাবে ই-মেইল চেক করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেছে নিন। অহেতুক দর্শনার্থী এড়াতে দেখামাত্র দাঁড়িয়ে যান, ‘কেমন আছেন’ এর পরিবর্তে সরাসরি জিজ্ঞেস করুন, ‘আপনার জন্য কী করতে পারি’।
কিছু দায়িত্ব ছেড়ে দিন:
অন্যকে দায়িত্ব দিতে পারার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা বুঝতে পারা যে আপনি যেভাবে করতেন এটা কখনও তেমন হবেনা। তাই হুবহু নিজের পছন্দমতো কাজ প্রত্যাশা না করে একটা নির্দিষ্ট মানের কাজ হলেই তা গ্রহণ করে ফেলুন।
পরিবেশকে টেনশনমুক্ত রাখুন- যখন হাতে অনেক কাজ জমে যায় তখন মন বিক্ষিপ্ত হয় বেশি। কোনটা ছেড়ে কোনটা করব -এই চিন্তায় কোনোটাতেই মন বসে না। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অর্থাৎ মনকে স্থির রাখতে আগে নিজের চারপাশকে স্থির করুন। অগোছালো ফাইলপত্র বা টেবিলে রাখা স্তূপকৃত বই খাতা মনকে বিক্ষিপ্ত করে বেশি। তাই যতদূর সম্ভব গুছিয়ে রাখুন জিনিসপত্র। যে বিষয় পড়তে চাইছেন, শুধু সেই বইটি সামনে রেখে বাকি সবকিছু দূরে সরিয়ে রাখুন। একইভাবে নিজের বিছানা বা আলমারি গুছিয়ে রাখুন।
আর, বস্তুগত পরিবেশের সমান গুরুত্বপূর্ণ হলো মানবিক পরিবেশ। কাদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন –এর উপরও নির্ভর করে আপনার স্ট্রেসের মাত্রা। খুব স্বাভাবিকভাবেই, যারা অহেতুক টেনশন করে তাদের সাথে যত থাকবেন তত আপনার স্ট্রেস বাড়বে। তাই বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হোন। হাসিখুশি-প্রাণোচ্ছল মানুষদের সাথে সময় কাটান বেশি। ফাউন্ডেশনে আসুন, যতক্ষণ পারেন এখানকার ইতিবাচক পরিবেশে কাটান। দেখবেন আপনার জীবনেও আনন্দের পরিমাণ বাড়ছে। আবেগকে প্রকাশ পেতে দিন- আবেগকে যত প্রকাশ করবেন তত স্ট্রেসমুক্ত হবেন। কীভাবে করবেন এই প্রকাশ?
কাঁদুন। প্রাণ খুলে কাঁদুন। নীরবে অথবা হাউ-মাউ করে কাঁদুন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদুন অথবা ডুকরে ডুকরে কাঁদুন। কান্নাকে মেয়েলি বা অপ্রয়োজনীয় মনে করারও কোনো কারণ নেই। সুস্থ মমতাভরা জীবনের জন্য কান্না অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনোবিজ্ঞানীরা এখন দাবি করছেন। এ কারণেই ভালোভাবে কাঁদার পর নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হয়।
হাসি হচ্ছে আনন্দ। হাসি হচ্ছে উচ্ছ্বলতা। হাসি হচ্ছে আশীর্বাদ। তাই হাসুন। প্রাণ ভরে হাসুন। চিৎকার করে হাসুন। শরীর দুলিয়ে হাসুন। আপনার শরীর শিথিল হবে, পেশীর টান-টান ভাব কমে আসবে। স্ট্রেসড্ বা ‘মাথা ভারি হয়ে থাকা’ অবস্থায় যে শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয় বা হার্টরেট কমে যায় –তার থেকেও মুক্তি দিতে পারে এই হাসি। তাই যত প্রাণখুলে নির্মলভাবে হাসতে পারবেন তত অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা না হারিয়েও জীবনকে কৌতুকপূর্ণভাবে দেখতে পারবেন।
বন্ধু বা প্রিয়জনের সাথে কথা বলুন। মন খুলে কথা বলুন, নিঃসংকোচে সমস্যার কথা বলতে পেরে অনেক হাল্কা বোধ করবেন।
আর যদি মনের মধ্যে রাগ-ক্ষোভের পাহাড় জমে থাকে তো একে ইচ্ছেমতো প্রকাশ পেতে দিন। না, অপর পক্ষের সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি বা শারীরিক আক্রমণ নয়; বরং এমন কিছুর উপর রাগ ঝাড়ুন যা টু-শব্দটিও করবে না। একটা লাথি বসিয়ে দিন ফুটবলে বা অনেকগুলো পত্রিকা এক করে ছিঁড়তে থাকুন। বাথরুমে গিয়ে চিৎকার করতে থাকুন যতক্ষণ না মনে শান্তি হয়। আর যদি আরো গভীর কোনো অভিমান জমে থাকে তো চলে যান মনের বাড়িতে। জমে থাকা পাপবোধ বা রাগকে প্রকাশ করে দিন। রাগ-ক্ষোভ-অভিমান –এর মেডিটেশনের বিশেষ ক্যাসেট অনুসরণ করুন।
নিজের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করুন কাজের চাপে টানা দুই/তিন রাত না ঘুমিয়ে, অনিয়ম করে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। আর এর পরদিন তিন/চারদিন মাথা ঝি-ধরে অবসন্ন থাকার অভিজ্ঞতাও নতুন নয়। বিষয়টা হলো শরীরকে যদি অবহেলা করেন তো আজ হোক কাল হোক এর প্রভাব পড়বেই। তাই ব্যস্ততার অজুহাতে অনিয়ম না করে ‘নিজে’র দেখভাল নিজে করুন। এ জন্য সহজ তিনটি নিয়ম অনুসরণ করতে পারেন:
খাদ্যাভ্যাস
অল্প অল্প করে অনেকবার না খেয়ে দিনে তিন বা দুইবার ভালো করে খান। বিশেষত সকালের খাবার বাদ দিবেন না। এতে রক্তে সুগারের পরিমাখ কমে যায়, দুপুরে ভারি খাওয়া মাত্র শরীর ছেড়ে দেয়। ফলে রাত হতে হতে কর্মশক্তির খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। আর অসময়ে ক্ষুধা পেলে ওমেগা-থ্রি সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- বাদাম খান। এতে দ্রুত চাঙ্গা বোধ করবেন।
ব্যায়াম
দিনের মধ্যে অন্তত ১৫ মিনিট সময় ব্যায়াম করুন। বহুক্ষণ কর্মক্ষম থাকবেন।
ঘুম
কম ঘুম দেহে বাড়তি স্ট্রেস হরমোন তৈরি করে। আবশ্য অতিরিক্ত ঘুমের প্রভাবও ভালো নয়।
তাই যতটুকু দরকার ঘুমিয়ে নিন। আর যদি মেডিটেশন করেন তাহলে এমনিতেই চাঙ্গা থাকবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, গভীর ঘুমের চেয়েও মেডিটেটিভ লেভেলে ল্যাকটেট-লেভেল ৪ গুণ বেশি কমে যায়। তাই যারা মেডিটেশন করেন তারা দীর্ঘক্ষণ টানা কাজ করতে পারেন। মেডিটেশন করুন৯০ বছর আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্ট ওয়াল্টার ক্যানন দেখান যে, স্ট্রেসড্ অবস্থায় ব্লাড প্রেশার ও হার্টবিট বাড়ে, পেশী টান-টান হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয়। দেহে কর্টিসল ও এড্রিনালিনের প্রবাহ বাড়ে। ওয়াল্টার ক্যানন দেখান যে কারণ যাই হোক না কেন, দেহে টেনশনের প্রভাবগুলো একইরকম হয়। একে বলে ‘ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স’ বা স্ট্রেস রেসপন্স।
এর প্রায় ৪০ বছর পর ড. হার্বার্ট বেনসন দেখান যে, আমাদের দেহে মেডিটেশনের প্রভাব স্ট্রেসজনিত উপসর্গের ঠিক বিপরীত। তাঁর প্রকাশিত বেস্টসেলার গ্রন্হ ‘রিলাক্সেশন রেসপন্স’-এ তিনি দেখান যে, নিয়মিত মেডিটেশনে মস্তিষ্ক অনেক সুস্থির হয় এবং ‘ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স’ -এর পরিবর্তে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। নিয়মিত মেডিটেশনে প্যারাসিম্পেথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের কার্যকারিতা বাড়ে এবং মনে ‘সুখ-সুখ’ ভাব উদ্রেককারী হরমোন সেরোটনিন-এর প্রবাহ বাড়ে।
ম্যাডিসনের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড ডেভিডসন ব্রেইন-ইমেজিং পদ্ধতির সাহায্যে দেখান যে, মেডিটেশনে ব্রেনের কার্যকারিতা ডান-প্রি-ফ্রন্টাল-কর্টেক্স থেকে বামে সরে যায়। এটি নির্দেশ করে ব্রেনের শিথিল ও আরামদায়ক অবস্থা। অর্থাৎ, মেডিটেশন ব্রেনের পুরো কর্মপন্থাকেই পাল্টে দেয় এবং স্ট্রেসমুক্ত ও প্রশান্ত অবস্থা নিশ্চিত করে।
‘অন্তরের আমি’র দিকে মনোযোগ দিন-
নবীজী (সাঃ) র জীবনের একটি ঘটনাঃ
একবার নবীজী (সাঃ) গাছের ডালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে দেখলেন এক লোক তরবারি তার বুকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নবীজী (সাঃ) কে দেখে সে বললো, এবার কে তোমাকে বাঁচাবে? প্রশান্ত, অবিচলিত নবীজী (সাঃ) মৃদুহাস্যে উত্তর দিলেন, আল্লাহ বাঁচাবেন আমাকে। এ উত্তরে ভড়কে গেল ঐ লোক। হাত থেকে ফেলে দিলো তরবারি। তখন নবীজী (সাঃ) তার গলায় তরবারি ধরে বললেন, এবার তুমি বলো- তোমাকে কে বাঁচাবে? ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে বললো, আপনি ছাড়া আর কেউ না! নবীজী (সাঃ) হাসলেন, তরবারি ছেড়ে যেতে দিলেন তাকে। এমন আচরণে অবাক ঐ লোক পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।
গৌতম বুদ্ধের একটি ঘটনাঃ
ভাই দেবদত্ত অনেকদিন ধরেই বুদ্ধকে হত্যা করার ফন্দি আঁটছিলো। সুযোগ বুঝে একদিন সে বুদ্ধের সামনে এক পাগলা হাতিকে ছেড়ে দেয়। মত্ত হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যায় এক অসহায় পথিক। শুঁড়ে করে মৃতদেহটিকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে হাতি এগিয়ে যায় বুদ্ধের দিকে। বুদ্ধ তখন দৌঁড় দেননি, ভয়ে চিৎকারও করে উঠেন নি। বরং দাঁড়িয়ে ছিলেন স্মিতহাস্যে। সেই হাসি বোধহয় ঐ পাগলা হাতির অন্তরেও পৌঁছেছিলো, না হয় কেন-ই বা সে বুদ্ধের পায়ের কাছে বসে পড়বে! কপালে বুদ্ধের মমতার স্পর্শ ঐ মত্ত হাতিকেও করেছিলো শান্ত, প্রশান্ত।
-কী ছিলো সেই শক্তি যা চরম বিপদের মুখেও আমাদের ধর্মনায়কদের রেখেছিলো ধীর-স্থির, প্রশান্ত? সেটি ছিলো সমর্পণের শক্তি, নিজের চাইতে বড় কোনো সত্তায় বিশ্বাসের শক্তি।
আমাদের দৈহিক সত্তা সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কারণ সে জানে মৃত্যু হলেই সে হারিয়ে যাবে। তাই তথাকথিত বৈষয়িক চাকচিক্যের মাঝে সে নিরাপত্তা খোঁজে। হারানোর ভয় তাকে সবসময় তাড়িত করে। অথচ আসল সুখের সন্ধান বাইরে নয়, আছে নিজের ভেতরে। প্রকৃত নিরাপত্তাবোধ তখনই আসবে যখন আপনি বিশ্বাস করতে শিখবেন সমগ্রতম সত্তায়, খুঁজে পাবেন আপনার ‘অন্তরের আমি’কে।
জৈবিক জীবন চারপাশের মানুষের মাঝে আশ্রয় পেতে চায়। আর আত্মিক জীবন আশ্রয় দিতে চায়। সে ভালোবাসতে জানে, জানে নিজেকে উজার করে দিতে। কেবল নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করাই তার উদ্দেশ্য নয়, অন্যের মঙ্গলই তার জীবনের লক্ষ্য।
আপনিও শামিল হোন এ আত্মিক অভিযাত্রায়। ভালোবাসা নেয়ার লোকের এ সমাজে অভাব নেই, অভাব আছে ভালোবাসা দেয়ার মানুষের। আপনিও হতে পারেন এমন একজন- যার কাছে মানুষ মমতা পেতে পারে। পরিণামে আপনার জীবন হয়ে উঠবে সুখী, পরিতৃপ্ত, সদা-আনন্দময়। কাজকে কীভাবে দেখছেন তার উপরও নির্ভর করে আপনার স্ট্রেসের মাত্রা। আপনি কি কাজকে মেধা বিকাশের সৃষ্টিশীল সুযোগ হিসেবে দেখছেন, নাকি দেখছেন টাকা উপার্জনের মাধ্যম- নিছক একটা চাকরি হিসেবে?
একবার কিছু নির্মাণ শ্রমিককে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- ‘আপনি কী করছেন?’ ১ম শ্রমিক বললো, আমি পাথর কাটছি। ২য় জন বললো, আমি এমনভাবে বর্গাকার পাথর কাটছি যাতে সেগুলো খাপমতো বসে যায়। আর শেষ শ্রমিক বললো, আমি একটি সৌধ নির্মাণ করছি।
এখানে তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষণীয়: প্রথমজনের কাছে এটা কেবল চাকরি। দ্বিতীয়জনের কাছে এটা নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির একটা মাধ্যম। আর তৃতীয়জনের কাছে এটা একটা সৃষ্টিশীল কাজ, ভালোবাসার কাজ।
এই তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটা হচ্ছে সঠিক। যদি ভালোবাসা যুক্ত হয় তাহলে কাজ নতুন রূপে প্রতিদিন ধরা দিবে আপনার কাছে। তখন আর একঘেয়ে বিরক্তিকর চাকরি নয়, বরং কাজ হবে আপনার প্রশান্তির উৎস। জীবনে বৈচিত্র্য আনুন-
কেবল অতিরিক্ত কাজই যে স্ট্রেস সৃষ্টি করে, তা না। কাজের অভাব বা আলস্যও স্ট্রেসের কারণ হতে পারে। তাই অতিরিক্ত বা বাড়তি সময় ঘুমিয়ে বা অকাজে ব্যয় না করে কোনো গঠনমূলক শখের চর্চা করুন। এটা হতে পারে বাগান করা, স্ট্যাম্প সংগ্রহ বা অন্য কিছু্। অথবা সময় দিন ফাউন্ডেশনের সৃষ্টির সেবামূলক কাজে।
জীবনে বৈচিত্র্য আনতে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে নতুন কিছু করা। যদি ভাবেন এতে ঝুঁকির আশংকা আছে, তাহলে নিন-না একটু ঝুঁকি। দেখবেন খারাপ কিছু হওয়ার ভয় থেকেও নতুন কিছু করার আনন্দ অনেক অনেক বেশি। সুবিন্যাসায়ন-
সুবিন্যাসায়ন অর্থাৎ সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর সহজ কয়েকটি উপায় হলো:
কাজের করণীয় নির্ধারণ: দিনের শুরুতে কী কী করতে হবে তার একটা তালিকা তৈরি করুন। বেশির ভাগ সময় যখন হাতে অনেক কাজ থাকে তখন কোনটা ছেড়ে কোনটা করবো এই চিন্তায় কোনোটাই করা হয়ে উঠেনা। একবার লিখে ফেললে এই ‘করণীয়’-র বোঝাটা অনেক হাল্কা হয়ে যায়। ভুলে যাওয়ার আশংকাও থাকে না।
পজিটিভ প্রভাব আমাদের কিছু করে দেখাতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে আর নেগেটিভ প্রভাব আমাদের সব দিক থেকে ক্ষতি করে থাকে। তাই স্ট্রেস কম করা একান্ত প্রয়োজন।
কিন্তু কীভাবে আপনি আপনার স্ট্রেস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন তার কয়েকটি উপায় আপনাকে জানানো হলো—
পরিমাণমত খাবার-দাবার করুন
আমাদের ধারণা আছে অ্যালকোহল গ্রহণ করলে বা বেশি পরিমাণে খাওয়া-দাওয়া করলে স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু খুব বেশি পরিমাণে খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস স্ট্রেস কমানোর বদলে তা বাড়িয়ে তোলে। তাই স্ট্রেস বেশি হলে পরিমাণমত খাবার খান। খুব বেশি খাবার খাওয়ার প্রয়োজন নেই।
নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিন
আপনি মনে রাখুন, অপরের ইচ্ছা পূর্ণ করা বা অন্যের অপেক্ষা করাই আপনার একমাত্র কাজ নয়। আপনার মনের মতো বিষয় বা বক্তব্য না হলে সেই প্রসঙ্গে না বলার অধিকার আপনার আছে। অন্যদের ইচ্ছা পূরণ করা থেকে নিজের ইচ্ছা অনুসারে চলুন। নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিন। আপনারও নিজস্ব কিছু ইচ্ছা আছে এবং তা পূরণ করা বা সেই ইচ্ছা অনুসারে জীবন ধারণ করার অধিকার আপনার আছে। আপনি নিজের অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন।
খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করুন
স্ট্রেস-ফ্রি হতে গিয়ে খুব বেশি চা বা কফি পান বা সিগারেট খাওয়ার মতো বদ অভ্যেসে অভ্যস্ত হবেন না। এর মধ্যে যে নিকোটিন থাকে তা স্ট্রেস বাড়িয়ে তোলে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
খুব কঠিন নয় এমন কিছু ব্যায়াম দৈনিক চর্চা করুন। মেডিটেশন বা ধ্যান, যোগব্যায়াম বা অ্যারোবিক্সের চর্চার ফলে শরীর থেকে ‘এন্ডোফিন’ নির্গত হয় যা স্ট্রেস কম করে এবং পজিটিভ চিন্তা-ভাবনা জাগিয়ে তোলে।
নিয়মিত পড়াশোনা করুন
নিজেকে রিল্যাক্স রাখুন। রিল্যাক্সেশনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া জেনে নিন। নিয়মিত পড়াশোনা করুন। অবসর সময় নষ্ট না করে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান বাড়ানোর জন্য নিয়মিত পড়াশোনার চর্চা করুন।
স্ট্রেসের কারণ কম করার চেষ্টা করুন:
প্রত্যেক ব্যক্তি মনে করেন জীবনে চাহিদার কোনো শেষ নেই। আর সব চাহিদা পূরণ করার জন্য এই জীবনকাল যথেষ্ট নয়। টাইম ম্যানেজমেন্ট শেখায় কীভাবে কম সময়ের মধ্যে আপনার সব প্রয়োজনীয় কাজ আপনি শেষ করতে সক্ষম হবেন। আপনার মুখ্য কাজ কী, নিয়মানুবর্তিতার দ্বারা কীভাবে সব কাজ সম্পন্ন করা যায় তা মেনে কাজ করে দেখুন সব কাজ সম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আপনি আপনার পরিবার এবং নিজের জন্যও অতিরিক্ত সময় পেয়ে যাবেন।
আপনার গুরুত্ব উপলব্ধি করুন
আপনার কাজে আপনার চিন্তাধারা বা বিচার বুদ্ধির বাস্তব রূপ তুলে ধরে। আপনি কতটা ব্যস্ত তা কারও কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার নয়। তাই আপনার গুরুত্ব এবং ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করুন। নিজেকে সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলুন। আপনি নিজেকে গুরুত্ব দিলে তবেই অন্যরা আপনাকে গুরুত্ব দেবে। নিজের লক্ষ্য স্থির করুন, যদি সব কিছু ঠিক থাকে তবুও মনে রাখবেন, একশ’ শতাংশ সফলতা কেউ পায় না। লক্ষ্য ঠিক রেখে সঠিক চিন্তা-ভাবনা অনুসারে নিজের কাজ করে যান।
নিজের জন্য কাজ করুনআপনার যখনই মনে হবে আপনার ওপর খুব বেশি কাজের চাপ পড়ছে, তখন ভেবে দেখুন কী করলে আপনার ভালো লাগবে। যা করতে আপনার ভালো লাগছে তাই করুন।
কাজকে ভালোবাসুন, কাজই আপনাকে প্রতিদান দেবে- অগ্রাধিকার ঠিক করুন: যে কোনো নির্দিষ্ট দিনে আমাদের হয়তো একশটা কাজ হাতে থাকে। কিন্তু এর মাত্র ১০% থাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাকিগুলোর অধিকাংশ কাজই অনুরোধে ঢেঁকি গেলা বা জরুরি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবং এই শেষ কাজগুলোই আমাদের বেশিরভাগ সময় নিয়ে নেয়। ফলে দিন শেষে দেখা যায় অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলোই করা হয়নি।
এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করুন। কী কী করতে হবে এর তালিকা হয়ে গেলে গুরুত্বের ভিত্তিতে টিক চিহ্ন দিন। যেগুলো না করলেও চলে সেগুলো কেটে দিন। এতে প্রয়োজনীয় কাজগুলো বাদ পড়বেনা।
সময়কে ছোট ছোট কাজে ভাগ করে দিন কোন কাজ কখন করবেন তার জন্য সময় ভাগ করে নিন।অপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য দিনের অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল সময় বেছে নিন। যেমন. কাউকে ফোন করতে হলে দুপুরে খাওয়ার আগে করুন। এতে অহেতুক কথায় সময় নষ্ট হওয়ার সুযোগ কম থাকবে। আবার খুব মনোযোগ দিয়ে করতে হবে এমন কাজের জন্য সেই সময়টাই বেছে নিন যখন লোকজনের অহেতুক আসা-যাওয়া কম হবে এবং দীর্ঘক্ষণ কেউ বিরক্ত করবে না।
‘না’ বলতে শিখুন সব কাজের কাজী হতে যাবেন না। এমন অনেক কাজ আছে যেগুলো না করলেও চলে। আপনার দিন থেকে ঐ কাজগুলো বাদ দিতে চেষ্টা করুন। এতে যে কেবল সময় নষ্ট হয় তাই না, অহেতুক ঝামেলা আমাদের বেশি স্ট্রেসড্ করে তোলে। নিউ-ইয়র্কের এক রিসার্চ ফার্ম ‘বেসেক্স’ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় অপ্রয়োজনীয় মোবাইলে আমাদের প্রতিদিন ১ থেকে ২ ঘন্টা নষ্ট হয়, যা এক কর্মদিবসের ২৮%।
তাই বেছে কাজ হাতে নিন। যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু করছেন তখন ফোন সাইলেন্ট রাখুন। পরে কল-ব্যাক করুন- যখন গাড়িতে জ্যামে বসে আসেন অথবা এমন সময় যখন আপনার ব্যস্ততা কম। একইভাবে ই-মেইল চেক করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেছে নিন। অহেতুক দর্শনার্থী এড়াতে দেখামাত্র দাঁড়িয়ে যান, ‘কেমন আছেন’ এর পরিবর্তে সরাসরি জিজ্ঞেস করুন, ‘আপনার জন্য কী করতে পারি’।
কিছু দায়িত্ব ছেড়ে দিন:
অন্যকে দায়িত্ব দিতে পারার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা বুঝতে পারা যে আপনি যেভাবে করতেন এটা কখনও তেমন হবেনা। তাই হুবহু নিজের পছন্দমতো কাজ প্রত্যাশা না করে একটা নির্দিষ্ট মানের কাজ হলেই তা গ্রহণ করে ফেলুন।
পরিবেশকে টেনশনমুক্ত রাখুন- যখন হাতে অনেক কাজ জমে যায় তখন মন বিক্ষিপ্ত হয় বেশি। কোনটা ছেড়ে কোনটা করব -এই চিন্তায় কোনোটাতেই মন বসে না। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অর্থাৎ মনকে স্থির রাখতে আগে নিজের চারপাশকে স্থির করুন। অগোছালো ফাইলপত্র বা টেবিলে রাখা স্তূপকৃত বই খাতা মনকে বিক্ষিপ্ত করে বেশি। তাই যতদূর সম্ভব গুছিয়ে রাখুন জিনিসপত্র। যে বিষয় পড়তে চাইছেন, শুধু সেই বইটি সামনে রেখে বাকি সবকিছু দূরে সরিয়ে রাখুন। একইভাবে নিজের বিছানা বা আলমারি গুছিয়ে রাখুন।
আর, বস্তুগত পরিবেশের সমান গুরুত্বপূর্ণ হলো মানবিক পরিবেশ। কাদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন –এর উপরও নির্ভর করে আপনার স্ট্রেসের মাত্রা। খুব স্বাভাবিকভাবেই, যারা অহেতুক টেনশন করে তাদের সাথে যত থাকবেন তত আপনার স্ট্রেস বাড়বে। তাই বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হোন। হাসিখুশি-প্রাণোচ্ছল মানুষদের সাথে সময় কাটান বেশি। ফাউন্ডেশনে আসুন, যতক্ষণ পারেন এখানকার ইতিবাচক পরিবেশে কাটান। দেখবেন আপনার জীবনেও আনন্দের পরিমাণ বাড়ছে। আবেগকে প্রকাশ পেতে দিন- আবেগকে যত প্রকাশ করবেন তত স্ট্রেসমুক্ত হবেন। কীভাবে করবেন এই প্রকাশ?
কাঁদুন। প্রাণ খুলে কাঁদুন। নীরবে অথবা হাউ-মাউ করে কাঁদুন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদুন অথবা ডুকরে ডুকরে কাঁদুন। কান্নাকে মেয়েলি বা অপ্রয়োজনীয় মনে করারও কোনো কারণ নেই। সুস্থ মমতাভরা জীবনের জন্য কান্না অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনোবিজ্ঞানীরা এখন দাবি করছেন। এ কারণেই ভালোভাবে কাঁদার পর নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হয়।
হাসি হচ্ছে আনন্দ। হাসি হচ্ছে উচ্ছ্বলতা। হাসি হচ্ছে আশীর্বাদ। তাই হাসুন। প্রাণ ভরে হাসুন। চিৎকার করে হাসুন। শরীর দুলিয়ে হাসুন। আপনার শরীর শিথিল হবে, পেশীর টান-টান ভাব কমে আসবে। স্ট্রেসড্ বা ‘মাথা ভারি হয়ে থাকা’ অবস্থায় যে শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয় বা হার্টরেট কমে যায় –তার থেকেও মুক্তি দিতে পারে এই হাসি। তাই যত প্রাণখুলে নির্মলভাবে হাসতে পারবেন তত অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা না হারিয়েও জীবনকে কৌতুকপূর্ণভাবে দেখতে পারবেন।
বন্ধু বা প্রিয়জনের সাথে কথা বলুন। মন খুলে কথা বলুন, নিঃসংকোচে সমস্যার কথা বলতে পেরে অনেক হাল্কা বোধ করবেন।
আর যদি মনের মধ্যে রাগ-ক্ষোভের পাহাড় জমে থাকে তো একে ইচ্ছেমতো প্রকাশ পেতে দিন। না, অপর পক্ষের সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি বা শারীরিক আক্রমণ নয়; বরং এমন কিছুর উপর রাগ ঝাড়ুন যা টু-শব্দটিও করবে না। একটা লাথি বসিয়ে দিন ফুটবলে বা অনেকগুলো পত্রিকা এক করে ছিঁড়তে থাকুন। বাথরুমে গিয়ে চিৎকার করতে থাকুন যতক্ষণ না মনে শান্তি হয়। আর যদি আরো গভীর কোনো অভিমান জমে থাকে তো চলে যান মনের বাড়িতে। জমে থাকা পাপবোধ বা রাগকে প্রকাশ করে দিন। রাগ-ক্ষোভ-অভিমান –এর মেডিটেশনের বিশেষ ক্যাসেট অনুসরণ করুন।
নিজের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করুন কাজের চাপে টানা দুই/তিন রাত না ঘুমিয়ে, অনিয়ম করে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। আর এর পরদিন তিন/চারদিন মাথা ঝি-ধরে অবসন্ন থাকার অভিজ্ঞতাও নতুন নয়। বিষয়টা হলো শরীরকে যদি অবহেলা করেন তো আজ হোক কাল হোক এর প্রভাব পড়বেই। তাই ব্যস্ততার অজুহাতে অনিয়ম না করে ‘নিজে’র দেখভাল নিজে করুন। এ জন্য সহজ তিনটি নিয়ম অনুসরণ করতে পারেন:
খাদ্যাভ্যাস
অল্প অল্প করে অনেকবার না খেয়ে দিনে তিন বা দুইবার ভালো করে খান। বিশেষত সকালের খাবার বাদ দিবেন না। এতে রক্তে সুগারের পরিমাখ কমে যায়, দুপুরে ভারি খাওয়া মাত্র শরীর ছেড়ে দেয়। ফলে রাত হতে হতে কর্মশক্তির খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। আর অসময়ে ক্ষুধা পেলে ওমেগা-থ্রি সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- বাদাম খান। এতে দ্রুত চাঙ্গা বোধ করবেন।
ব্যায়াম
দিনের মধ্যে অন্তত ১৫ মিনিট সময় ব্যায়াম করুন। বহুক্ষণ কর্মক্ষম থাকবেন।
ঘুম
কম ঘুম দেহে বাড়তি স্ট্রেস হরমোন তৈরি করে। আবশ্য অতিরিক্ত ঘুমের প্রভাবও ভালো নয়।
তাই যতটুকু দরকার ঘুমিয়ে নিন। আর যদি মেডিটেশন করেন তাহলে এমনিতেই চাঙ্গা থাকবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, গভীর ঘুমের চেয়েও মেডিটেটিভ লেভেলে ল্যাকটেট-লেভেল ৪ গুণ বেশি কমে যায়। তাই যারা মেডিটেশন করেন তারা দীর্ঘক্ষণ টানা কাজ করতে পারেন। মেডিটেশন করুন৯০ বছর আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্ট ওয়াল্টার ক্যানন দেখান যে, স্ট্রেসড্ অবস্থায় ব্লাড প্রেশার ও হার্টবিট বাড়ে, পেশী টান-টান হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয়। দেহে কর্টিসল ও এড্রিনালিনের প্রবাহ বাড়ে। ওয়াল্টার ক্যানন দেখান যে কারণ যাই হোক না কেন, দেহে টেনশনের প্রভাবগুলো একইরকম হয়। একে বলে ‘ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স’ বা স্ট্রেস রেসপন্স।
এর প্রায় ৪০ বছর পর ড. হার্বার্ট বেনসন দেখান যে, আমাদের দেহে মেডিটেশনের প্রভাব স্ট্রেসজনিত উপসর্গের ঠিক বিপরীত। তাঁর প্রকাশিত বেস্টসেলার গ্রন্হ ‘রিলাক্সেশন রেসপন্স’-এ তিনি দেখান যে, নিয়মিত মেডিটেশনে মস্তিষ্ক অনেক সুস্থির হয় এবং ‘ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স’ -এর পরিবর্তে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। নিয়মিত মেডিটেশনে প্যারাসিম্পেথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের কার্যকারিতা বাড়ে এবং মনে ‘সুখ-সুখ’ ভাব উদ্রেককারী হরমোন সেরোটনিন-এর প্রবাহ বাড়ে।
ম্যাডিসনের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড ডেভিডসন ব্রেইন-ইমেজিং পদ্ধতির সাহায্যে দেখান যে, মেডিটেশনে ব্রেনের কার্যকারিতা ডান-প্রি-ফ্রন্টাল-কর্টেক্স থেকে বামে সরে যায়। এটি নির্দেশ করে ব্রেনের শিথিল ও আরামদায়ক অবস্থা। অর্থাৎ, মেডিটেশন ব্রেনের পুরো কর্মপন্থাকেই পাল্টে দেয় এবং স্ট্রেসমুক্ত ও প্রশান্ত অবস্থা নিশ্চিত করে।
‘অন্তরের আমি’র দিকে মনোযোগ দিন-
নবীজী (সাঃ) র জীবনের একটি ঘটনাঃ
একবার নবীজী (সাঃ) গাছের ডালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে দেখলেন এক লোক তরবারি তার বুকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নবীজী (সাঃ) কে দেখে সে বললো, এবার কে তোমাকে বাঁচাবে? প্রশান্ত, অবিচলিত নবীজী (সাঃ) মৃদুহাস্যে উত্তর দিলেন, আল্লাহ বাঁচাবেন আমাকে। এ উত্তরে ভড়কে গেল ঐ লোক। হাত থেকে ফেলে দিলো তরবারি। তখন নবীজী (সাঃ) তার গলায় তরবারি ধরে বললেন, এবার তুমি বলো- তোমাকে কে বাঁচাবে? ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে বললো, আপনি ছাড়া আর কেউ না! নবীজী (সাঃ) হাসলেন, তরবারি ছেড়ে যেতে দিলেন তাকে। এমন আচরণে অবাক ঐ লোক পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।
গৌতম বুদ্ধের একটি ঘটনাঃ
ভাই দেবদত্ত অনেকদিন ধরেই বুদ্ধকে হত্যা করার ফন্দি আঁটছিলো। সুযোগ বুঝে একদিন সে বুদ্ধের সামনে এক পাগলা হাতিকে ছেড়ে দেয়। মত্ত হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যায় এক অসহায় পথিক। শুঁড়ে করে মৃতদেহটিকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে হাতি এগিয়ে যায় বুদ্ধের দিকে। বুদ্ধ তখন দৌঁড় দেননি, ভয়ে চিৎকারও করে উঠেন নি। বরং দাঁড়িয়ে ছিলেন স্মিতহাস্যে। সেই হাসি বোধহয় ঐ পাগলা হাতির অন্তরেও পৌঁছেছিলো, না হয় কেন-ই বা সে বুদ্ধের পায়ের কাছে বসে পড়বে! কপালে বুদ্ধের মমতার স্পর্শ ঐ মত্ত হাতিকেও করেছিলো শান্ত, প্রশান্ত।
-কী ছিলো সেই শক্তি যা চরম বিপদের মুখেও আমাদের ধর্মনায়কদের রেখেছিলো ধীর-স্থির, প্রশান্ত? সেটি ছিলো সমর্পণের শক্তি, নিজের চাইতে বড় কোনো সত্তায় বিশ্বাসের শক্তি।
আমাদের দৈহিক সত্তা সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কারণ সে জানে মৃত্যু হলেই সে হারিয়ে যাবে। তাই তথাকথিত বৈষয়িক চাকচিক্যের মাঝে সে নিরাপত্তা খোঁজে। হারানোর ভয় তাকে সবসময় তাড়িত করে। অথচ আসল সুখের সন্ধান বাইরে নয়, আছে নিজের ভেতরে। প্রকৃত নিরাপত্তাবোধ তখনই আসবে যখন আপনি বিশ্বাস করতে শিখবেন সমগ্রতম সত্তায়, খুঁজে পাবেন আপনার ‘অন্তরের আমি’কে।
জৈবিক জীবন চারপাশের মানুষের মাঝে আশ্রয় পেতে চায়। আর আত্মিক জীবন আশ্রয় দিতে চায়। সে ভালোবাসতে জানে, জানে নিজেকে উজার করে দিতে। কেবল নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করাই তার উদ্দেশ্য নয়, অন্যের মঙ্গলই তার জীবনের লক্ষ্য।
আপনিও শামিল হোন এ আত্মিক অভিযাত্রায়। ভালোবাসা নেয়ার লোকের এ সমাজে অভাব নেই, অভাব আছে ভালোবাসা দেয়ার মানুষের। আপনিও হতে পারেন এমন একজন- যার কাছে মানুষ মমতা পেতে পারে। পরিণামে আপনার জীবন হয়ে উঠবে সুখী, পরিতৃপ্ত, সদা-আনন্দময়। কাজকে কীভাবে দেখছেন তার উপরও নির্ভর করে আপনার স্ট্রেসের মাত্রা। আপনি কি কাজকে মেধা বিকাশের সৃষ্টিশীল সুযোগ হিসেবে দেখছেন, নাকি দেখছেন টাকা উপার্জনের মাধ্যম- নিছক একটা চাকরি হিসেবে?
একবার কিছু নির্মাণ শ্রমিককে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- ‘আপনি কী করছেন?’ ১ম শ্রমিক বললো, আমি পাথর কাটছি। ২য় জন বললো, আমি এমনভাবে বর্গাকার পাথর কাটছি যাতে সেগুলো খাপমতো বসে যায়। আর শেষ শ্রমিক বললো, আমি একটি সৌধ নির্মাণ করছি।
এখানে তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষণীয়: প্রথমজনের কাছে এটা কেবল চাকরি। দ্বিতীয়জনের কাছে এটা নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির একটা মাধ্যম। আর তৃতীয়জনের কাছে এটা একটা সৃষ্টিশীল কাজ, ভালোবাসার কাজ।
এই তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটা হচ্ছে সঠিক। যদি ভালোবাসা যুক্ত হয় তাহলে কাজ নতুন রূপে প্রতিদিন ধরা দিবে আপনার কাছে। তখন আর একঘেয়ে বিরক্তিকর চাকরি নয়, বরং কাজ হবে আপনার প্রশান্তির উৎস। জীবনে বৈচিত্র্য আনুন-
কেবল অতিরিক্ত কাজই যে স্ট্রেস সৃষ্টি করে, তা না। কাজের অভাব বা আলস্যও স্ট্রেসের কারণ হতে পারে। তাই অতিরিক্ত বা বাড়তি সময় ঘুমিয়ে বা অকাজে ব্যয় না করে কোনো গঠনমূলক শখের চর্চা করুন। এটা হতে পারে বাগান করা, স্ট্যাম্প সংগ্রহ বা অন্য কিছু্। অথবা সময় দিন ফাউন্ডেশনের সৃষ্টির সেবামূলক কাজে।
জীবনে বৈচিত্র্য আনতে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে নতুন কিছু করা। যদি ভাবেন এতে ঝুঁকির আশংকা আছে, তাহলে নিন-না একটু ঝুঁকি। দেখবেন খারাপ কিছু হওয়ার ভয় থেকেও নতুন কিছু করার আনন্দ অনেক অনেক বেশি। সুবিন্যাসায়ন-
সুবিন্যাসায়ন অর্থাৎ সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর সহজ কয়েকটি উপায় হলো:
কাজের করণীয় নির্ধারণ: দিনের শুরুতে কী কী করতে হবে তার একটা তালিকা তৈরি করুন। বেশির ভাগ সময় যখন হাতে অনেক কাজ থাকে তখন কোনটা ছেড়ে কোনটা করবো এই চিন্তায় কোনোটাই করা হয়ে উঠেনা। একবার লিখে ফেললে এই ‘করণীয়’-র বোঝাটা অনেক হাল্কা হয়ে যায়। ভুলে যাওয়ার আশংকাও থাকে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন