মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১১

ঢাকার বাতাসে বিষ

দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছেন ব্যবসায়ী ইসমাইল চৌধুরী। এপ্রিলের শেষের দিকে কাজ শেষে রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন তিনি। কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে একটি বাস তার রিকশার সামনে থামার পর ধোঁয়া সরাসরি তার চোখে লাগে। কিছুক্ষণ পর ডান চোখে ব্যথা অনুভব করেন। তার চোখ লাল হয়ে যায় এবং ফুলে ওঠে। চিকিৎসকের কাছে গেছেন, নিয়মিত ওষুধও খাচ্ছেন, এখনও তিনি ভালো হচ্ছেন না।
ডায়াবেটিক হাসপাতালের (বারডেম) সহযোগী অধ্যাপক ডা. মানস কুমার গোস্বামী সমকালকে জানান, বায়ুদূষণের ফলে রাজধানীর ৬০ শতাংশ মানুষ চোখের সমস্যায় ভুগছে। দূষিত বায়ুর প্রভাবে 'ড্রাই আই' বা চোখে জলশূন্যতা দেখা দেয়। ফলে চোখ ফুলে ওঠে, চোখে চুলকানি হয়, চোখের পানি শুকিয়ে যায়। আর ঢাকার বেশির ভাগ মানুষের এ রোগ হয়। তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা শতকরা ৮০ ভাগ জলশূন্যতা রোগে ভোগে।
রাজধানীর বাতাসে বিষ কমছে না। বাতাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ভেসে বেড়াচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান কার্বন মনো-অক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, দৃশ্যমান ধুলোবালি ও অদৃশ্য বস্তুকণা। বিশেষ করে ঢাকার বাতাসে বস্তুকণার উপস্থিতি বেশি। পরিবেশ অধিদফতর ও ক্লিন এয়ার ইনিশিয়েটিভ_ এশিয়া সেন্টারের ২০০৮ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই রাজধানীর বাতাসে বস্তুকণার উপস্থিতি মানবদেহের গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ছিল। ২০০৭ সালে রাজধানীর বাতাসে পিএম ২.৫ (২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণা) ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রামের বেশি। আর পিএম ১০ (১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণা) ছিল ১৩০ মাইক্রোগ্রামের বেশি। পরিবেশ অধিদফতরের সহনীয় মানমাত্রায় পিএম ২.৫ হচ্ছে ১৫ মাইক্রোগ্রাম আর পিএম ১০ হচ্ছে ৫০ মাইক্রোগ্রাম।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. উত্তম কুমার বড়ূয়া সমকালকে জানান, এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বায়ুদূষণে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকার নাম আর প্রথম মেক্সিকো। গ্রহণযোগ্য মাত্রার অতিরিক্ত সিসা ও বস্তুকণার উপস্থিতিতে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে রয়েছে রাজধানী ঢাকার শিশু,
বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীরা। তিনি জানান, বাতাসে অতিরিক্ত পরিমাণ সিসার উপস্থিতি অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেয়। শিশুদের ব্রংকিউলাইটিস রোগ বেশি হয়। এ ছাড়া শিশু মানসিক ভারসাম্যহীনও হতে পারে।
পরিবেশ অধিদফতর পরিচালিত নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ (কেস) প্রকল্পের কনসালট্যান্ট ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস জানিয়েছেন, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি_ এ তিন মাস বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি থাকে। তিনি জানান, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক দু'ভাবেই বাতাস দূষিত হচ্ছে। গৃহ নির্মাণের জন্য উন্মুক্তভাবে বালু রাখা, ইট ভাঙা, সিমেন্টের সঙ্গে ইট-বালু মেশানো, পুরনো গাড়ি থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া ইত্যাদি দিয়ে স্থানীয়ভাবে দূষিত হচ্ছে বায়ু। তিনি জানান, ধূলিকণা এক স্থানে থাকে না। বাতাসের সহায়তায় এরা হাজার মাইল পাড়ি দেয়। বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকার বায়ুদূষণে ইরান অনেকাংশে দায়ী। ইরানের দূষিত বায়ু ভারত হয়ে এ দেশে আসছে। তিনি আরও জানান, ঢাকার বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে ইটভাটাগুলো। ২০০৮ সালের এক হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর আশপাশের ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৫শ'র বেশি ইটভাটা রাজধানীর বায়ু দূষণ করছে।
রাজধানীর বাতাস দূষণমুক্ত রাখতে পরিবেশবান্ধব বাহন রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, বৈদ্যুতিক ট্রেনকে সরকারিভাবে উৎসাহ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক একিউএম মাহবুব। তিনি আরও বলেছেন, রাজধানীর বাতাসের ওপর 'মনিটরিং' আরও জোরদার করতে হবে। রাজধানী থেকে পুরনো গাড়ি উঠিয়ে দিতে হবে, শিল্প-কারখানায় ইটিপি স্থাপন করতে হবে। তিনি আরও জানান, গরমের সময় রাজধানীর বাতাস বেশি দূষিত হয়। তাই মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে সরকার ব্যর্থ দাবি করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ড. এমএ মতিন বলেছেন, রাজধানী থেকে টু স্ট্রোক থ্রি হুইলার উঠিয়ে দেওয়ার পর এখানের বাতাসের অবস্থা কিছুটা উন্নত হলেও এর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বিশেষ করে পুরনো গাড়ির ধোঁয়া রাজধানীর বাতাসকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে। সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
রাজধানীর বাতাসে বিষ কমছে না উল্লেখ করে বাপার নির্বাহী পরিচালক আবু নাসের খান বলেছেন, রাস্তার দু'পাশে আকাশছোঁয়া ভবনগুলোর ফলে ঢাকার বাতাসে জমা ক্ষতিকর উপাদানগুলো সহজে সরে যেতে পারে না। এ ছাড়া নিষিদ্ধ হওয়ার পরও পুরনো গাড়িগুলোর অবাধ চলাফেরা রাজধানীর বাতাসকে আরও দূষিত করছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন