রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১১

নারীর ক্যান্সার : সচেতনতা দরকার


বিশ্বে মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন স্তনের ক্যান্সারে। অনুমিত হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ১০ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মহিলা প্রতিবছর নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার মহিলা উন্নত দেশগুলোর, বাকিরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর।
বাংলাদেশে মহিলাদের ক্যান্সার হিসেবে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের স্থান শীর্ষে, দ্বিতীয় স্থানে স্তন ক্যান্সারÑ এটাই বরাবরের ধারণা। তবে হাসপাতালভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি থেকে সাম্প্রতিক পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের স্থান শীর্ষে। এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির জন্যই প্রতিবছর অক্টোবর মাসটি ‘স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। আর এর প্রতীক ‘পিংক রিবন’ নিয়ে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চলছে


‘স্তন ক্যান্সার নিয়ে পুরোপুরি ধারণা না থাকলেও কিছুটা ছিল। তাই উপসর্গগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনার পর স্তন পরীক্ষা করে জানতে পারি, স্তনে একটি পিণ্ড ধরা পড়েছে। এটাই পরে ক্যান্সারে রূপ নেবে। সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করিয়ে পিণ্ড বের করা হয়। আজ থেকে তিন বছর আগের ঘটনা এটি। এরপর আর কোন সমস্যা অনুভব করিনি। এখন ভালো আছি।’ বলছিলেন খুরশীদা আক্তার। স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে গেছেন রেহানা আহমেদও। বলছিলেন সেই দিনগুলোর কথা। ‘আমি শিক্ষিত। সরকারি বড় কর্মকর্তা। কিন্তু স্তন ক্যান্সার নিয়ে কখনও কিছু জানতে চাইনি। প্রায়ই স্তনে কিছু সমস্যা দেখা দিত। পাত্তা দিতাম না। হঠাৎ দেখলাম খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। আমার চেহারা ও চামড়ার রঙে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে তিনি আমাকে কিছু পরীক্ষা দেন। তারপর আমার রিপোর্টগুলো একজন অনকোলজি বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠান। এখানেই ধরা পড়ে আমার ক্যান্সার। এরপর সার্জারি করা হল। থেরাপি দেয়া হল। দীর্ঘ ছয় মাস চিকিৎসার পর এখন আমি সুস্থ।’ বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আছেন আফরোজা খাতুন। তার স্তনে সার্জারি হয়েছে। বললেন, ‘২০০৮ সালে প্রথম স্তনে ব্যথা অনুভব করলে ঢাকায় এসে অনকোলজি ডাক্তার দেখাই। স্তনে ছোট গোটা ধরা পড়লে তারা বলেন, এটা তেমন সমস্যা নেই। ওষুধ দিয়ে বলল, গোটা বড় হলে ঢাকায় চলে আসবেন। আমি ওষুধ খাওয়া শুরু করলে ব্যথা চলে যায়। গোটাটাও বড় হয় না। আমি ভাবছি ভালো হয়ে গেছি। তাই আর ডাক্তারের কাছে আসিনি। পনেরো দিন আগে নিজের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের সব লক্ষণ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় চলে আসি। এরপর সার্জারি করা হয়। সামনে থেরাপি দেয়া হবে। অসচেতনতার জন্য আজ এত কষ্ট করতে হল।’
স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে শুধু জানলেই হবে না। এটা নিয়ে সচেতন হতে হবে এবং সেই জানাটা কাজে লাগাতে হবে। নারীদের জন্য স্তন ক্যান্সার একটি নীরব ব্যাধি। একে প্রতিরোধ করতে হলে এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। সে জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে এবং অস্বাভাবিক কিছু মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক অথবা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। 
শরীরের অন্যান্য স্থানের মতো স্তনে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির ফলে কোন চাকা বা পিণ্ডের সৃষ্টি হয়। এটি পিণ্ড বা চাকা হিসেবেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে বড় হয় এবং শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। স্তনের সঙ্গে নিকটস্থ বগলতলায় লসিকাগ্রন্থি বা গ্লান্ডগুলোর খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় এগুলোতে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি। ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর কারণ হিসেবে সারা বিশ্বে স্তন ক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয়, শীর্ষে রয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার। আর মহিলাদের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্তনের ক্যান্সারই রয়েছে শীর্ষস্থানে। বিশ্বে মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন স্তনের ক্যান্সারে। এর হার বছরে প্রতি এক লাখ মহিলার মধ্যে আশিজনের বেশি। অনুমিত হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ১০ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মহিলা প্রতিবছর নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার মহিলা উন্নত দেশগুলোর, বাকিরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর। বাংলাদেশে মহিলাদের ক্যান্সার হিসেবে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের স্থান শীর্ষে, দ্বিতীয় স্থানে স্তন ক্যান্সারÑ এটাই বরাবরের ধারণা। তবে হাসপাতালভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি থেকে সাম্প্রতিক পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের স্থান শীর্ষে। 
স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি, কারণ সম্পর্কে আমরা জানতে চেয়েছিলাম জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার এপিডেমিওলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং সেন্টার ফর ক্যান্সার প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের (সিসিপিআর) চেয়ারম্যান ডাক্তার মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিনের কাছে। তিনি বললেন, ‘পুরুষেরও স্তন ক্যান্সার হতে পারে। তবে মহিলাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একশ গুণ বেশি। নারীদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। বিআরসিএ-১ এবং বিআরসিএ-১ নামের জিনের মিউটেশন ৫ থেকে ১০ ভাগ স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী। পরিবারে কোন মহিলা যেমনÑ মা, খালা, বড়বোন বা মেয়ে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকলে ঝুঁকি বেশি থাকে। যেসব মহিলার ১২ বছর বয়সের আগে ঋতুস্রাব শুরু হয় এবং ৫০ বছর বয়সের পর মেনোপজ বন্ধ হয় তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া এক স্তনে ক্যান্সার হয়ে থাকলে অন্যটিতেও ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে বিষয়গুলোয় ঝুঁকি বেশি থাকে তা হলÑ নিঃসন্তান হলে, ৩০ বছর বয়সের পর বিয়ে ও প্রথম সন্তানের মা হওয়া, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, শাকসবজি ও ফলমূল কম খেলে, চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খেলে, অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক পরিশ্রমের অনভ্যাস থাকলে ঝুঁকি বেশি থাকে।’ তিনি স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হিসেবে বললেন, ‘স্তনে চাকা বা পিণ্ড, স্তনের বোঁটা বা নিপল ভেতরে ঢুকে যাওয়া, অসমান বা বাঁকা হয়ে যাওয়া, স্তনের বোঁটা দিয়ে অস্বাভাবিক রস বা রক্তক্ষরণ হওয়া, চামড়ার রঙ বা চেহারায় পরিবর্তন, বগলতলায় পিণ্ড বা চাকা দেখলেই তাদের স্ক্রিনিং করতে হবে। স্ক্রিনিং হচ্ছে, যাদের লক্ষণ দেখা দেয়নি কিন্তু ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সহজ কোন পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে স্তন ক্যান্সারের রোগী খুঁজে বের করার নাম ক্যান্সার স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাম, ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন, ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন এই পদ্ধতিতে স্ক্রিনিং করা হয়। তবে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন। মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রত্যেক মহিলা যদি নিয়মিতভাবে নিজের স্তন ভালোভাবে পরীক্ষা করেন তাহলে যে কোন ধরনের অসামঞ্জস্য ও পরিবর্তন নিজেই প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করতে পারবেন। যদি অস্বাভাবিক কোন পরিবর্তন ধরা পড়ে তাহলে চিকিৎসক অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে স্তন পরীক্ষা করাতে হবে। চিকিৎসক যদি কোন চাকা বা পিণ্ড অথবা অন্য কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন শনাক্ত করেন, তবে পরামর্শমতো ম্যামোগ্রাম, স্তনের আল্ট্রাসনোগ্রাম ও অন্যান্য পরীক্ষা করাতে হবে। স্তনে পিণ্ড বা চাকা হলে যেমন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি সব চাকাই যে ক্যান্সার তাও নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেছে, স্তনের চাকার ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ শেষ পর্যন্ত ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত হয়। বাকি ৯০ ভাগই বিনাইন টিউমার বা অন্য কোন সাধারণ রোগ, যা সহজেই নিরাময় সম্ভব। কাজেই সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগের ধরন জানা অত্যন্ত জরুরি। স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে নিরাময়ের সম্ভাবনা শতভাগ।’
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা, রোগীর মানসিক অবস্থা, পরিবারের করণীয় বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আমরা জানতে চেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির গাইনি ও অনকোলজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডাক্তার আসরাফুন্নেসার কাছে। তিনি বললেন, ‘স্তন ক্যান্সার হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। অনেক পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা চিকিৎসার ঝুঁকি নেন না। এটা একটা অর্থনৈতিক কারণ। অনেকে অজ্ঞতার কারণে রোগীকে সান্ত্বনা না দিয়ে নানারকম কথা বলে থাকেন। আসলে পরিবারের একটু ভালো ব্যবহারে রোগী মানসিকভাবে অনেক সুস্থ হতে পারেন।’ স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গুরুতর অবস্থায় এর সার্জারি করা হয়। এছাড়াও রোগীদের চার ধরনের থেরাপি দেয়া হয়। রেডিয়েশন থেরাপি, কেমোথেরাপি, এন্ট্রি-ইসট্রোজেন থেরাপি, বায়োলজিক্যাল থেরাপি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এর চিকিৎসা রয়েছে। এছাড়াও এখানে প্রতিদিন স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারের ওপর কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। ২০০৩ সালে আমরা যখন কাউন্সিলিং শুরু করি তখন দু-তিনজন মহিলা আসতেন। এখন অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ৪০ থেকে ৫০ জন মহিলা আসেন। তার মানে সবাই কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছেন। 
এখানে স্তন পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও নির্বাচিত ইউনিয়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র এবং জেলা সদর হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে স্তন পরীক্ষা করা হয়।’ স্তন ক্যান্সারের সার্জিক্যাল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘সার্জারি করতে ৫ থেকে সাত দিন সময় লাগে। সার্জারির পরে যদি দরকার হয় তাহলে থেরাপি দেয়া হয়। সঙ্গে অন্যান্য চিকিৎসা করা হয়। এতে একজন রোগী সুস্থ হয়ে যান। অনেক সময় সার্জারি না করে শুধু অন্যান্য চিকিৎসায় রোগী ভালো হয়ে যান। এখানে ফ্রি বেডে সার্জারির খরচ হয় সাত থেকে দশ হাজার টাকা। তবে আমি বলব সচেতনতাই পারে নারীদের এ রোগ থেকে মুক্ত রাখতে।’ 
সুত্রঃ যুগান্তর থেকে 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন