শুক্রবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১১

শীতে হাঁপানি

নিয়মিত ইনহেলার ব্যবহারে হাঁপানির প্রকোপ কমে (ছবিটি প্রতীকী) সমকাল
শীতের এই ফুরফুরে হাওয়া সবার মনে দোলা দিলেও হাঁপানি রোগীর জন্য এই ঋতু এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা। সাধারণভাবে সব হাঁপানি রোগীর ঠাণ্ডা পড়লেই শ্বাসকষ্ট হয়। কারণ ঠাণ্ডা বাতাসে পানির ভাগ কম থাকে, যা সরাসরি শ্বাসনালি সংকুচিত করে। তাছাড়া শীতে ভাইরাস রোগ হয় খুব বেশি। এছাড়া আবহাওয়ায় গাড়ির ধোঁয়া, কুয়াশা, সিগারেটের ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া এবং সাধারণ ধুলাবালি থাকলেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তাই বছরের এ সময় সব হাঁপানি রোগীর শারীরিক সুস্থতার জন্য অধিকতর সাবধানতা অবশ্যই প্রয়োজন।
হাঁপানি শ্বাসনালির প্রদাহজনিত অতি সংবেদনশীলতার কারণে হয়ে থাকে। এ রোগ হলে শ্বাসনালি খুব বেশি স্পর্শকাতর থাকে। ফলে সামান্য কারণেই এতে সংকোচন দেখা দেয়। সংকুচিত শ্বাসনালির পথ সংকীর্ণ হয়ে গেলে শরীরে স্বাভাবিক বাতাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ফলে কখনও শরীরে অক্সিজেন সরবরাহও কমে যেতে পারে। সংকীর্ণ শ্বাসনালির মধ্য দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সময় ঘন ঘন কাশি ও দম বন্ধ হয়ে যাওয়া বা দম ফুরিয়ে যাওয়ার মতো অনুভূত হয়।
উপসর্গ বা লক্ষণ :বুকের ভেতর বাঁশির মতো সাঁই সাঁই শব্দ হওয়া ষ শ্বাস নিতে-ছাড়তে কষ্ট হওয়া ষ দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা ষ ঘন ঘন কাশি ষ বুকে আঁটসাঁট অথবা দম বন্ধ ভাব ষ স্বস্তিতে রাতে ঘুমাতে না পারা। অ্যালার্জেনের জন্য শ্বাসনালিতে তিন ধরনের পরিবর্তন ঘটে_ সরু শ্বাসনালির চারপাশের মাংস সংকুচিত হয় এবং শ্বাসনালি আরও সরু করে ফেলে, ফলে শ্বাসকষ্ট হয় ষ মিউকাস জাতীয় আঠালো পানি নিঃসৃত হয়, যা শ্বাসনালির পথ বন্ধ করে দেয় ষ শ্বাসনালির মধ্যে প্রদাহ তৈরি হয়। ফলে শ্বাসতন্ত্রের আবরণী ফুলে ওঠে। তাই শ্বাসনালির পথ আরও সংকুচিত হয়ে যায়।
অ্যালার্জেন কী : ঘরবাড়ির ধুলায় থাকা 'মাইট' নামে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র কীট, পাখির পালক, জীবজন্তুর পশম, ছত্রাকের স্পোর, রান্নার ধোঁয়া, সিগারেটের ধোঁয়া, কিছু খাদ্য যেমন_ পালং শাক, মিষ্টি কুমড়া, ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, সালফার জাতীয় কিছু ওষুধ, শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিক পদার্থ।
অ্যালার্জির উপসর্গ : শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার আগে সাধারণত চোখ লাল হয়, নাক থেকে পানি পড়ে, নাক চুলকায়, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হয় এবং কখনও কখনও গায়ে লাল চাকা ওঠে।
চিকিৎসা : হাঁপানির লক্ষণগুলো যদি কম ঘন ঘন ও মৃদু হয়, তাহলে আপনাকে শর্ট-অ্যাক্টিং বিটা২ এগনিস্ট নামে একটি ওষুধযুক্ত ইনহেলার দেওয়া হবে। হাঁপানির লক্ষণগুলো থেকে আরোগ্য লাভের জন্য আপনার এটি নিয়মিত সময় অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত। আপনার রোগ লক্ষণগুলো যদি বেশি ঘন ঘন হয়, তাহলে আপনাকে একটি দ্বিতীয় ইনহেলার দেওয়া হবে, যার মধ্যে ইনহেলড কর্টিকোস্টেরয়েড নামে একটি ওষুধ থাকে। আপনার রোগ লক্ষণগুলো প্রতিরোধ করার জন্য আপনাকে সাধারণত রোজ দু'বার ইনহেলড কর্টিকোস্টেরয়েডের ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হবে।
যদি আপনার হাঁপানির লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে আপনাকে অতিরিক্ত ওষুধ দেওয়া হতে পারে যেমন_ লং-অ্যাক্টিং বিটা২ এগনিস্ট অথবা লিউকোট্রায়েন-এডাল্ট রিসেপ্টর এন্টাগনিস্ট। এরপর দেওয়া হয় মুখে খাওয়ার স্টেরয়েড। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই নিরুপায় হয়ে শেষ পর্যায়ে এটি দেওয়া হয়।
বিটা২ এগনিস্টের বর্ধিত ডোজের সাহায্যে হাঁপানির আক্রমণের চিকিৎসা করা যেতে পারে। তীব্র আক্রমণের ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসা করার প্রয়োজন হতে পারে, যেখানে অক্সিজেন, বিটা২ এগনিস্ট এবং মুখে সেবনের স্টেরয়েডের সংমিশ্রণ ব্যবহার করে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
প্রতিরোধ : ধূমপান বন্ধ করুন। শিশুরা সিগারেটের ধোঁয়ার সংস্পর্শে এলে তাদের হাঁপানি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
রোগের কোনো লক্ষণ আরও খারাপ হতে থাকলে তা খেয়াল করে এবং আপনি যে খাবার বা ওষুধ রোগ লক্ষণের কারণ বলে মনে করেন, সেগুলো খাওয়ার পর পিক ফ্লো মিটার ব্যবহার করে হাঁপানির সূচনাকারী পদার্থগুলো চিহ্নিত করুন। ওজন কমান, নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
আপনার যদি তীব্র হাঁপানি থাকে, তাহলে জটিলতার বর্ধিত ঝুঁকির কারণে আপনাকে প্রতি বছর ফ্লুয়ের টিকা নিতে হবে। নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস ও রক্তের সংক্রমণের জন্য দায়ী নিউমোকক্কাল ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধেও আপনার একটি টিকা নেওয়া উচিত।
ভালো থাকুন শীতকালেও :ঠাণ্ডা বাতাস যেন সরাসরি শ্বাসনালিতে প্রবেশ না করে, সে জন্য মাস্ক বা মুখে রুমাল ব্যবহার করা যেতে পারে। ষ নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস করুন। কারণ নাক দিয়ে শ্বাস নিলে বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা উভয়ই বেড়ে যায় এবং এতে শ্বাসনালি স্বস্তি পায়। ষ সাধারণ ঠাণ্ডা বা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যতটুকু সম্ভব চোখ, নাক বা মুখে হাত দেওয়ার অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করুন। ষ নাক পরিষ্কার করার জন্য টিস্যুপেপার ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবহারের পর তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার অভ্যাস করুন। হাঁচি-কাশির সময় অবশ্যই মুখে কাপড় ব্যবহার করুন ষ ঘরের মধ্যে ধূমপান করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে ষ নিজে নিজে ঘর ঝাড়া-মোছা, কাপড় পরিষ্কার করা থেকে বিরত থাকুন ষ বাসায় কার্পেট ব্যবহার করবেন না। বিশেষ করে শোয়ার ঘরে কোনো অবস্থায়ই কার্পেট রাখবেন না ষ বিছানায় লোমযুক্ত চাদর, কাঁথা, লেপ বা কম্বল ও বালিশ ব্যবহার করবেন না। বিছানা অবশ্যই চাদর দিয়ে ঢেকে রাখবেন, যাতে ধুলাবালি না পড়ে ষ পোষা পাখির খাঁচা, লোমযুক্ত প্রাণী যেমন_ বিড়াল, কুকুর, হাঁস-মুরগি বাড়িতে রাখবেন না ষ রান্না করার সময় অবশ্যই রান্নাঘরের জানালা খুলে রাখবেন। রান্নাঘরের ধোঁয়া যাতে শোয়ার ঘরে প্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
কার কোন কোন জিনিসে অ্যালার্জি হয়, সে সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে এবং তা থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকতে হবে।
হাঁপানির চিকিৎসা দেশেই সম্ভব। এ জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া খেয়ে প্রতারিত হওয়াও উচিত নয়।
বছরের অন্য সময়ের মতো শীতকালেও হাঁপানি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ আছে কি-না তা জানা প্রয়োজন। এর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত ওষুধের ধরন ও মাত্রা ঠিক করে নিন। নিয়মিত হাঁপানির রোগ বাধাদানকারী ওষুধ ব্যবহার করুন। ভালো থাকুন শীতকালেও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন